বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রতীকের মধ্যে অন্যতম আলোচিত একটি প্রতীক হচ্ছে 'ধানের শীষ'। এই প্রতীক দীর্ঘদিন ধরে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই প্রতীকটি নতুনভাবে আলোচনায় এসেছে একজন সাধারণ মানুষের ব্যতিক্রমী উদ্যোগের কারণে। বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার যুবক ইউসুফ হাওলাদার নিজের তৈরি এক পোশাকের মাধ্যমে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন, যেটি পুরোপুরি তৈরি করা হয়েছে ধানের শীষ দিয়ে। প্রশ্ন উঠেছে—কেন এমন ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিলেন ইউসুফ হাওলাদার?
রাজনৈতিক ভালোবাসা থেকে শিল্প
ইউসুফ হাওলাদার একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হলেও তার রাজনৈতিক সচেতনতা এবং ভালোবাসা তাকে বিশেষ করে তুলেছে। তিনি জানান, “ধানের শীষ আমার বিশ্বাস, আমার আত্মার প্রতীক। এটা কেবল একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীক নয়, এটি আমার সংগ্রাম, আমার প্রত্যাশা, আমার আত্মপরিচয়ের অংশ।” তার এই মন্তব্যে ফুটে ওঠে একজন সাধারণ নাগরিকের রাজনৈতিক ভাবনা এবং সেই ভাবনার শিল্পরূপ।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং বিএনপির আদর্শের প্রতি তার রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা। বিশেষ করে সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে তৈরি হওয়া আশার আলো এবং বদলের বার্তা তাকে উৎসাহিত করেছে এই উদ্যোগ নিতে।
ধানের শীষ দিয়ে পোশাক তৈরির প্রক্রিয়া
ধানের শীষ সাধারণত খুব নাজুক ও ঝরে পড়ার উপযোগী উপাদান। তাই ইউসুফ হাওলাদার এই প্রতীক ব্যবহার করে একটি পূর্ণাঙ্গ পোশাক তৈরি করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তিনি ধান সংগ্রহ করেছেন নিজ এলাকা থেকে এবং প্রথমে সেগুলোকে কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে কাঠিন্য বাড়িয়েছেন। এরপর তিনি সুতা ও আঠা দিয়ে শীষগুলোকে একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে বসিয়ে নকশা তৈরি করেছেন। পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে তার সময় লেগেছে প্রায় ১৫ দিন।
তিনি একটি পাঞ্জাবির মতো দেখতে পোশাক তৈরি করেছেন, যার পুরো গায়ে শুধুমাত্র ধানের শীষ দিয়ে ডিজাইন করা। ন্যাচারাল রঙ বজায় রেখেই তিনি কাজটি সম্পন্ন করেছেন, যাতে প্রতীকের বাস্তবতা অটুট থাকে।
সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল
ইউসুফ হাওলাদারের এই ব্যতিক্রমী পোশাক তৈরি নিয়ে প্রথমে একটি স্থানীয় সাংবাদিক ফেসবুকে একটি ছবি পোস্ট করেন। তারপর থেকেই ফেসবুক, টিকটক ও ইউটিউবে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই উদ্যোগ। বিশেষ করে বিএনপি সমর্থক মহলে এটি একটি গর্বের বিষয় হিসেবে প্রচারিত হয়। অনেকে বলছেন, এই ধরনের উদ্যোগ রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি গণমানুষের সঙ্গে প্রতীকের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করে।
বিপরীত মত ও বিতর্ক
তবে এই উদ্যোগ নিয়ে সবাই একমত নন। অনেকেই এটিকে 'রাজনৈতিক মার্কেটিং' এর অংশ বলে মনে করছেন। তাদের মতে, একজন সাধারণ মানুষ হঠাৎ করে এই ধরনের উদ্যোগ নেয়া অস্বাভাবিক এবং এর পেছনে হয়তো কোনো প্ররোচনা রয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনী মৌসুমের আগে এমন একটি ঘটনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে।
তবে ইউসুফ হাওলাদার এসব অভিযোগ সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমি কারো নির্দেশে কিছু করিনি। এটা আমার মনের ইচ্ছা ছিল। আমি চাইলে এটা বানিয়ে চুপচাপ রেখে দিতে পারতাম। কিন্তু আমি চাই মানুষ জানুক—ধানের শীষ আমার গর্ব, আমার পরিচয়।”
স্থানীয় প্রতিক্রিয়া
বাবুগঞ্জ উপজেলায় ইউসুফ হাওলাদার এখন অনেকের কাছে পরিচিত মুখ। তার প্রতিবেশীরা জানান, সে বরাবরই ভিন্নধর্মী চিন্তা করে এবং শিল্প ও সংস্কৃতিতে আগ্রহী। স্থানীয় এক মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, “ইউসুফের এই কাজটি রাজনীতির বাইরে গিয়েও একটি সামাজিক বার্তা দেয়—যে একজন সাধারণ মানুষ চাইলে তার মত প্রকাশ করতে পারে সৃজনশীলভাবে।”
বিএনপির প্রতিক্রিয়া
বিএনপির কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় কোনো নেতার পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না মিললেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় দলের অনেক কর্মী ও সমর্থক ইউসুফ হাওলাদারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। বিএনপির বরিশাল অঞ্চলের একজন ছাত্রদল নেতা বলেন, “ইউসুফ ভাই আমাদের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন রাজনীতির প্রতি ভালোবাসা কেমন হতে পারে।”
নতুন বার্তা?
ইউসুফ হাওলাদারের এই উদ্যোগ রাজনীতির বাইরেও একটি নতুন বার্তা দিয়েছে—সাধারণ মানুষ চাইলে নিজস্ব চিন্তা, মতবাদ এবং ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেন সৃজনশীল উপায়ে। এ থেকে অনুপ্রেরণা পেতে পারেন দেশের আরও অনেক তরুণ, যারা রাজনৈতিক বা সামাজিক বিষয়ে অবদান রাখতে চান ভিন্ন আঙ্গিকে।