সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত মানবপাচার মামলার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রী অবশেষে আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। আত্মসমর্পণের পর আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। মানবপাচারের অভিযোগে দায়ের করা মামলাটিতে তাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগ উঠেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিদেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ ও মানুষ পাচারের মতো ভয়াবহ অপরাধ।
মামলার পটভূমি
মিল্টন সমাদ্দার, একজন কথিত মানবাধিকারকর্মী এবং এনজিও পরিচালক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার স্ত্রীকেও তিনি এই কাজে অংশীদার করেছেন বলে অভিযোগ। তদন্তে উঠে এসেছে, তারা দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়ার নামে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেন।
বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তারা অসংখ্য মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলেন। এসব মানুষ চাকরির আশায় সর্বস্ব বিক্রি করে টাকা দিলেও পরে জানতে পারে, ভিসা বা চাকরির কোনো বৈধ ব্যবস্থা হয়নি। অনেকে অবৈধভাবে পাচার হয়ে গিয়ে বিদেশে নানা রকম হয়রানি ও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য
সরকারি তদন্ত সংস্থার তথ্যমতে, মিল্টন ও তার স্ত্রী যৌথভাবে একটি এনজিওর ছত্রছায়ায় এই প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। এই এনজিও ছিল শুধুমাত্র একটি মুখোশ, যার আড়ালে তারা পাচার চক্রের কার্যক্রম চালিয়ে যেতেন। তদন্তে আরও জানা গেছে, তাদের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ জন মানুষ বিদেশে পাচার হয়েছেন, যার মধ্যে অন্তত ৫০ জন এখনো নিখোঁজ।
এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের অভিবাসন দপ্তর থেকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রতিবেদন আসে যেখানে বলা হয়, কিছু বাংলাদেশি প্রতারিত হয়ে মানবপাচারকারীদের মাধ্যমে ওইসব দেশে গেছেন। এসব ঘটনার সূত্র ধরেই মূলত এই দম্পতির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।
আত্মসমর্পণ ও আদালতের নির্দেশ
চলমান মামলাটিতে দীর্ঘদিন ধরেই পলাতক ছিলেন মিল্টন ও তার স্ত্রী। অবশেষে তারা ঢাকার একটি মহানগর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণের পর তারা জামিন প্রার্থনা করলে আদালত তা খারিজ করে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালত বলেছে, মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ ও স্পর্শকাতর। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ রয়েছে যা মানবপাচারের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়।
সামাজিক প্রতিক্রিয়া
মিল্টন সমাদ্দার একসময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মানবাধিকার ও সমাজসেবার নামে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি একাধিক অনুষ্ঠান ও কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন এবং একাধিক সামাজিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। তবে বর্তমানে তার বিরুদ্ধে এই ভয়াবহ অভিযোগ সামনে আসার পর তার সেই ভাবমূর্তি ধূলিসাৎ হয়েছে।
অনেক ভুক্তভোগী ইতোমধ্যে মিডিয়ার সামনে এসেছেন এবং তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, মিল্টনের আশ্বাসে তারা জমি বিক্রি করে টাকা দিয়েছিলেন, কেউ আবার এনজিও অফিসে সাক্ষাৎ করে ভিসার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত তারা প্রতারিত হন এবং কেউ কেউ অবৈধভাবে বিদেশে গিয়ে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন।
সরকারের অবস্থান
সরকার ইতোমধ্যেই এই ধরনের মানবপাচার চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে মানবপাচার রোধে কোনো ধরনের শিথিলতা না থাকে। এই মামলার মধ্য দিয়ে সরকারের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরবর্তী পদক্ষেপ
মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রীর রিমান্ড চেয়ে পুলিশ আবেদন করেছে বলে জানা গেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে পাচারচক্রের অন্যান্য সদস্যদের নামও বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তদন্তকারীরা আশা করছেন, এই মামলার মাধ্যমে দেশের একটি অন্যতম মানবপাচার চক্রের কার্যকলাপ সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত হবে।