'আপনাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে কিন্তু পাকিস্তানিরা আসলেই মেধাবী'

0

 

“আপনাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে, কিন্তু পাকিস্তানিরা আসলেই মেধাবী”—এই কথাটি শোনামাত্র অনেকের চোখ কুঁচকে যেতে পারে। কারণ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, যুদ্ধ, এবং আধিপত্য বিস্তারের ইতিহাস আমাদের মনোজগতে পাকিস্তানিদের একটি নেতিবাচক ছবি এঁকে দিয়েছে। তবে বাস্তবতা হলো, যে কোনো জাতির মতো পাকিস্তানিরাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্যিই মেধার পরিচয় দিয়েছে, যা অস্বীকার করার উপায় নেই।


প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনে এগিয়ে

বর্তমানে পাকিস্তান প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে। বিশেষ করে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), এবং ফ্রিল্যান্সিং সেক্টরে পাকিস্তানি তরুণরা বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছে। ২০২৪ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পাকিস্তান এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সিং জাতি, যেখানে লাখ লাখ তরুণ ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।


তাদের মধ্যে অনেকেই আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে স্বীকৃতি পেয়েছেন। যেমন, আরফা করিম—যিনি মাত্র ৯ বছর বয়সে মাইক্রোসফট সার্টিফায়েড প্রফেশনাল (MCP) হয়ে বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন। এমন উদাহরণ মেধার পরিচয় বহন করে।


শিক্ষা ও গবেষণায় অবদান

পাকিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে গেলেও, কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান যেমন লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সেস (LUMS), ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (NUST), এবং আগা খান ইউনিভার্সিটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এখানে থেকে পাশ করা শিক্ষার্থীরা হার্ভার্ড, এমআইটি, অক্সফোর্ডের মতো প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছে।


সম্প্রতি পাকিস্তানের একদল গবেষক ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন একটি সম্ভাব্য থেরাপি আবিষ্কার করেছে, যা বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলেছে। পাকিস্তানের মেধাবীরা ধীরে ধীরে গবেষণাক্ষেত্রেও তাদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।


সাহিত্য, সংগীত ও সংস্কৃতিতে প্রতিভার ছাপ

পাকিস্তানের সাহিত্যে যেমন রয়েছে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, পারভিন শাকির, আহমেদ ফারাজের মতো অসাধারণ কবি-সাহিত্যিক, তেমনি সংগীতাঙ্গনেও রয়েছে বিশাল অবদান। পাকিস্তানি সংগীতশিল্পী নুসরাত ফতেহ আলী খান, আতিফ আসলাম বা আবিদা পারভিন শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, বিশ্বজুড়েই খ্যাতিমান। তাদের কণ্ঠ ও সুর বিশ্ব শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছে।


এছাড়া পাকিস্তানি নাটক এবং সিনেমার মানও উন্নত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র যেমন “Bol”, “Khuda Kay Liye”, কিংবা সম্প্রতি “Joyland” কানের চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়েছে।


খেলাধুলা ও আন্তর্জাতিক অর্জন

ক্রিকেটে পাকিস্তানের মেধা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। ইমরান খান, ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস থেকে শুরু করে বাবর আজম পর্যন্ত—তারা প্রতিভা ও দক্ষতায় বিশ্বমঞ্চে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুধু ক্রিকেট নয়, স্কোয়াশ, হকি, এবং স্নুকারেও পাকিস্তানিদের অর্জন রয়েছে।


পাকিস্তানের মেধা কেবল খেলোয়াড়দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তাদের ক্রীড়া বিশ্লেষক, ধারাভাষ্যকার ও প্রশিক্ষকরা অনেক দেশেই সফলভাবে কাজ করছেন।


নারীদের অগ্রগতি

অবশ্য পাকিস্তানে নারীদের পরিস্থিতি এখনো চ্যালেঞ্জিং। তবে এই প্রতিকূলতার মধ্যেও অনেক নারী অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছেন। মালালা ইউসুফজাই—যিনি নারী শিক্ষা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তালেবানদের গুলিতে আহত হয়েও পিছপা হননি, বরং নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেছেন।


তাছাড়া মারিয়া তোরপেকাই ওয়াজিরি নামক এক নারী আন্তর্জাতিক স্কোয়াশ খেলোয়াড় হয়েছেন, যিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত উপজাতীয় এলাকা থেকে উঠে এসেছেন।


সমস্যা সত্ত্বেও সম্ভাবনা

পাকিস্তান যে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং নিরাপত্তাজনিত সংকটে ভুগছে, তা অস্বীকার করা যায় না। দুর্নীতি, অশিক্ষা, এবং মৌলবাদের মতো চ্যালেঞ্জগুলো দেশটিকে বারবার পিছিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যেও যে একটি বড় জনগোষ্ঠী শিক্ষা, উদ্ভাবন ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রাখছে, সেটি মেধারই প্রতিফলন।


বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা থাকে, তবে পাকিস্তান তার বিপুল জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তর করে দক্ষিণ এশিয়ার একটি উদীয়মান অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে।


বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে ধাক্কা

বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের মাঝে পাকিস্তান নিয়ে যে অনুভূতি, তা ১৯৭১ সালের যুদ্ধ এবং তাদের সামরিক বর্বরতার কারণে যথার্থই নেতিবাচক। তবে একে অপরকে ঘৃণা করে নয়, বরং প্রতিযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়াটাই হবে বেশি কার্যকর।


পাকিস্তানিদের মেধাকে স্বীকার করার মানে এই নয় যে তাদের অতীতের অন্যায় ভুলে যাওয়া; বরং এটি একটি বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া—যাতে আমরা নিজেরাও শেখার জায়গা পাই এবং উন্নয়নের পথে দ্রুত অগ্রসর হতে পারি।

Post a Comment

0Comments
Post a Comment (0)
To Top