সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে পাকিস্তানি মিডিয়া আবারো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে, যখন তারা ভারতীয় মিডিয়ার বিভিন্ন বিতর্কিত প্রতিবেদন ও বক্তব্যের বিরুদ্ধে কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিশেষ করে জম্মু ও কাশ্মীর, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, এবং সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা ঘিরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কিছু মনগড়া তথ্য ও উসকানিমূলক প্রচারণার জবাবে পাকিস্তানের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো 'উপযুক্ত জবাব' দিয়েছে বলে দাবি করছে দেশটির বিশ্লেষকরা।
ভারতীয় মিডিয়ার প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারণা
গত কয়েক সপ্তাহে ভারতীয় মিডিয়ার কিছু চ্যানেল পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উপস্থাপন করে বিভিন্ন বিতর্কিত প্রতিবেদন প্রচার করে। বিশেষ করে কিছু চ্যানেল দাবি করে যে, পাকিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং তাদের ভারতের অভ্যন্তরে হামলার জন্য পাঠাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তানি মিডিয়া একাধিক অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন, আলোচনাসভা এবং প্রামাণ্য ভিডিও প্রকাশ করে দাবি করে যে, এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
বিশেষ করে জিও নিউজ, ডনের মত শীর্ষস্থানীয় পাকিস্তানি চ্যানেলগুলো আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ, সাবেক কূটনীতিক এবং সামরিক বিশ্লেষকদের যুক্ত করে ভারতের "নিউ প্রোপাগান্ডা মেশিন" কৌশলের বিপরীতে তথ্যভিত্তিক প্রচার শুরু করে। ‘আরইউএন নিউজ’ এর বিশ্লেষণে বলা হয়, “ভারতীয় মিডিয়া এখন একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার, যা ভারতীয় জনমতকে প্রভাবিত করতে এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক মনোভাব তৈরি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে।”
কাশ্মীর প্রসঙ্গে পাকিস্তানের পাল্টা অবস্থান
কাশ্মীর ইস্যুতে ভারতের একতরফা বক্তব্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি মিডিয়া আন্তর্জাতিক আইন এবং জাতিসংঘের রেজোলিউশনের আলোকে তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করে। বেশ কয়েকটি প্রাইম টাইম টকশোতে পাকিস্তানি বিশ্লেষকরা বলেন, কাশ্মীর একটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত বিতর্কিত অঞ্চল এবং এর সমাধান একমাত্র কাশ্মীরিদের ইচ্ছার ভিত্তিতেই সম্ভব। এ বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদন এবং পুরনো জাতিসংঘ অধিবেশনের ভিডিও ফুটেজ প্রচার করা হয়।
জিও টিভির বিশ্লেষক কামরান ইউসুফ বলেন, “ভারতীয় মিডিয়া আজ এমন এক ন্যারেটিভ তৈরি করছে যেখানে কাশ্মীরের বাস্তবতা চাপা পড়ে যাচ্ছে। আমরা সেটির বিরুদ্ধে তথ্য ও যুক্তির মাধ্যমে কথা বলছি, গালিগালাজ বা সেন্সেশনালিজম দিয়ে নয়।”
পানি সংকট ও অভিন্ন নদী বণ্টন ইস্যুতে প্রতিবাদ
সম্প্রতি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আবারো ‘ইন্দাস ওয়াটার ট্রিটি’ পুনরায় বিবেচনার ইঙ্গিত আসায় পাকিস্তানে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ভারতীয় মিডিয়ায় প্রচারিত হয়, ভারত এই চুক্তি বাতিল করার অধিকার রাখে এবং পাকিস্তানকে পানি সরবরাহ বন্ধ করতে পারে। এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানি মিডিয়া চুক্তির আইনগত দিক তুলে ধরে এবং ভারতের একতরফা সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে।
ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “ইন্দাস চুক্তি একটি আন্তর্জাতিক গ্যারান্টি প্রাপ্ত চুক্তি এবং একতরফাভাবে ভারত সেটি ভঙ্গ করলে এটি শুধু পাকিস্তানের জন্য নয়, পুরো অঞ্চলের জন্য বিপজ্জনক উদাহরণ সৃষ্টি করবে।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা
পাকিস্তানি মিডিয়া শুধু নিজেদের দেশের জনমত গঠনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে ইংরেজি ভাষায় প্রতিবেদন ও প্রামাণ্যচিত্র প্রচার শুরু করেছে। তারা বিবিসি, আল-জাজিরা, সিএনএন প্রভৃতি আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিবেদন তুলে ধরে দাবি করছে যে ভারতীয় মিডিয়া আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতার ন্যূনতম মান বজায় রাখছে না এবং কৃত্রিম উত্তেজনা তৈরি করে রাজনৈতিক লাভের চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষক ফাহাদ হুসেইন বলেন, “পাকিস্তান এতদিন চুপ ছিল, কিন্তু এখন আমরা তথ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সত্য উন্মোচনের চেষ্টা করছি। ভারত যদি মিডিয়া প্রোপাগান্ডাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে পাকিস্তান যুক্তি ও নৈতিকতাকে অস্ত্র বানাবে।”
ভারতের মিডিয়া প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানি মিডিয়ার এমন পাল্টা জবাবের পর ভারতীয় মিডিয়াতেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কিছু মিডিয়া পাকিস্তানকে “মিথ্যা প্রচারের” অভিযোগে অভিযুক্ত করলেও, কিছু বিশ্লেষক বলছেন, এমন পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় উপমহাদেশের মিডিয়া যুদ্ধ আরো উত্তপ্ত হচ্ছে এবং এর থেকে উত্তরণ দরকার। ভারতীয় সাংবাদিক রবিশ কুমার এক মতামত কলামে লেখেন, “দুই দেশের মিডিয়ার এই বস্তুনিষ্ঠতার অভাব সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করছে।”